যুক্তরাষ্ট্রের নয়া ভিসানীতিতে শঙ্কা-সম্ভাবনার দোলাচলে বিএনপি!

1 min read

বাংলাদেশে নির্বাচন ইস্যুতে মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর রাজনীতির ‘জল ঘোলা’ দেখছেন বিএনপি নেতারা। এটা তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির আন্দোলন সহায়ক বলে প্রকাশ্যে উচ্ছ্বাস দেখালেও নির্বাচনে বাধাদানকারীরা যেহেতু ভিসানীতির আওতায় পড়বেন তাই এ নিয়ে অভ্যন্তরে আশঙ্কাও রয়েছে।

বিএনপি সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতিমালাকে স্বাগত জানিয়েছে তারা। আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্তটি তাদের পক্ষেই গেছে বলে মনে করেন দলটির নেতারা। যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করছেন, তারই পক্ষে সিদ্ধান্তটি এলো। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলেই তারা নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছেন। এখন এই আন্দোলনকে সরকারি দলের দাবি অনুযায়ী আবার সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যুক্তরাষ্ট্র এটিকে বাধা হিসেবে মনে করবেন কি না সেটা ভাবার বিষয়। এখানে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আশঙ্কা ওখানেই, তারপর কি হবে? জল ঘোলা পরিস্থিতি। এই পরিস্থিতিতে কে কাকে শিকার করবে, কে কার শিকার হবে?

নেতাদের মতে, সরকারি দল বিদেশিদের সামনে লোক দেখানো একটি পথ খোলা রাখতে পারে। ফলে বিদেশিদের ‘ধোকা’দিয়ে নির্দলীয় সরকারের দাবি না মেনেই বিরোধী দলগুলোকে নির্বাচনে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এতে বিরোধী দলগুলোর ঐক্য ধরে রাখা কঠিন হতে পারে। পাশাপাশি বিদেশিরা আশ্বস্ত হলে সরকারের ওপরও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার বিষয়ে ‘চাপ’থাকবে না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু নির্বাচনে সে আশ্বাস রক্ষা করেননি তিনি। নির্বাচন ইস্যুতে নাইজেরিয়া, উগান্ডায় মার্কিন পদক্ষেপ খুব বেশি কার্যকর হয়েছে বলে দেখা যায়নি।

আমেরিকা যা করছে তা তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্যই করছে। নতুন বিশ্ব গড়ার কারিগর ‘রাশিয়া’ ও ‘চীনের’ দিকে হাঁটছে বাংলাদেশ ঠিক তখনই আমেরিকার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা বাংলাদেশকে নিজের কব্জায় নিতে এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। যার জন্যই বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে।

তবে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেই বিএনপি পদক্ষেপ নিচ্ছে। পুলিশের দ্বারা যে সব নেতাকর্মীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সেই সব কর্মকর্তাদের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য নিতে সারা দেশে নেতাকর্মীদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। আগামী জুলাই মাস নাগাদ তারুণ্যের সমাবেশ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে।

গত ২৪ মে বুধবার রাতে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধাদানকারীদের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন এক টুইট বার্তায় ওই ঘোষণা দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, নতুন নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি ব্যক্তির জন্য ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপে করতে পারবে। পরে দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের কয়েকটি ধারা অনুযায়ী এ ভিসানীতি ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়া হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে এবং এক্ষেত্রে তারা পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

মার্কিন দপ্তরের ভাষ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র সর্বত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সমর্থন করে। নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বর্তমান বা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি নির্বাচনে বাধাদানকারীর পরিবারের নিকটতম সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল নয় বরং দলমত নির্বিশেষে নির্বাচন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি এ বিধিনিষেধের আওতাধীন থাকবে। নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নীতি প্রযোজ্য হবে।

ওই নীতি ঘোষণার পরদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে তার বাসায় একই টেবিলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা বসেন। মার্কিন ভিসানীতি ও রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর হিসাব কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে।

একাধিক সূত্র বলছে, ভিসানীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়ার বিষয় নিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা আলোচনা করছেন। ইতিমধ্যে দলটিতে সহিংসতা মুক্ত থেকে কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া যদি নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে ক্ষসতাসীনরা আলোচনা করতে চায় সেক্ষেত্রে বিএনপির ভূমিকা কী হবে তা নিয়েও দলীয় ফোরামে আলোচনা হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের পদত্যাগের আগে কোনো আলোচনা নয় এমন অবস্থানে অনড় না সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনার টেবিলে যাওয়া উচিত তা নিয়েও হিসাব-নিকেশ চলছে।

রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি বাংলাদেশের জন্য লজ্জার। তবে আমাদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের আরও উৎসাহ জোগাবে। কারণ আমরাও সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চাই।

সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত জীবন হাসান বলেন, মার্কিন প্রশাসন গণতন্ত্রের রাইট ট্র্যাকের কথা বলছে। আমরা বলছি রাইট ট্র্যাকে যেতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দরকার।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, পৃথিবীর যেখানেই যে বা যারা একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র কায়েম করতে যাচ্ছে এটা তাদের জন্য একটা সিগন্যাল। এর আগে তারা যতগুলো দেশে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সবগুলো দেশই একঘরে হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

তিনি বলেন, এখানে বিরোধী দলেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিরোধী দল তো মার খেতে খেতে অস্থির। তারা আবার বাধা দেবে কখন। মার খাওয়া আর কারাগারে ছাড়া তো ভাগ্যে কিছু নেই আমাদের। এখানে আমাদের বিঘ্ন সৃষ্টি করার কিছু নেই, যা করার সরকার এবং সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা করছে।

আলাল বলেন, আমরা যারা বিএনপি করি তারা অবশ্যই বাংলাদেশের নাগরিক। দেশ হিসেবে যদি এরকম লজ্জাজনক অবস্থায় পড়তে হয় তাহলে সেটা অবশ্যই বিএনপির জন্য দুশ্চিন্তার। রাজনৈতিক কারণে এটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। উগ্র রাজনীতি তো আর আমরা করি না।

যুক্তরাষ্ট্রের এ অবস্থানের ফলে বিএনপির চলমান আন্দোলন এবং দাবির ক্ষেত্রে অনুভব প্রভাব পড়বে কি না জানতে চাইলে আলাল বলেন, মানুষ উৎসাহিত হবে। সরকার ইচ্ছে করলেই আগের মতো বাধা দিতে পারবে না। সমাবেশগুলোতে আক্রমণ কম হবে। মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার মতো কোনো চাপ মার্কিন এই নীতিতে নেই বলেও মনে করেন তিনি।

আরেক যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ভিসানীতিতে বিরোধী দলের কথা বলা হয়েছে। বিএনপি বিরোধী দল নয়। বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। বিএনপির এখানে কোনো টেনশন নেই।

ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ভিসার বিষয়ে আমেরিকা যে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা বাংলাদেশের জন্য গুরুতর ঘটনা। এই দেশটা দখলদারদের কবলে পড়েছে। দেশের ভাবমূর্তি চরিত্র বদলে ফেলা হয়েছে। কারণ সংবিধানে সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি ছিল সেটি ছিল কেয়ারটেকার সরকার। সেজন্য দুশ্চিন্তা ক্ষমতাসীনদের জন্য সরকারের জন্য। কারণ তারা দেশে থাকে, তাদের পরিবার বিদেশ থাকে আমার মনে হয় এটা মাথায় রেখেই আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুতরাং সরকারের লোকজন যদি নীতির মধ্যে পড়ে বিদেশের থাকা তাদের পরিবারের সদস্যরা এর আওতায় পড়বে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিদেশ বিষয়ক কমিটির প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় সেটিই ভিসা নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। এদেশে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে সে দেশের চাওয়া ও বিএনপির চাওয়া এক। সেটি হলো একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। যার জন্য প্রয়োজন নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার।

নতুন ভিসানীতি ও মার্কিন রাষ্ট্রদূত দলগুলোর মধ্যে থেকে আলোচনার যে তাগিদ দিয়েছেন সে ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকারকেই আগে ভাবতে হবে। পরে বিএনপি ভেবে দেখবে।

+ There are no comments

Add yours